স্বদেশ ডেস্ক:
রাজধানীর পল্লবীতে ৬ বছর বয়সী এক শিশুর সামনে তার বাবাকে কুপিয়ে খুন করার চাঞ্চল্যকর কাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে একের পর এক বিস্ময়কর তথ্য। এক ঢিলে তিন পাখি মারতে চেয়েছিলেন সাহিনুদ্দিন খুনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অভিযুক্ত লক্ষ্মীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এম এ আউয়াল। এক. সাহিনুদ্দিনকে খুন, দুই. সাহিনুদ্দিনের খুনি হিসেবে যাকে ভাড়া করেছিলেন সেই কিলার সুমনকেও এর পরের ধাপে খুন এবং তিন আবাসন ব্যবসায়ে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত যিনি, সুমন খুনে তাকেও জড়ানো।
জমির বিরোধে পল্লবীর আলীনগরে সাহিনুদ্দিনকে খুনের পর এ কিলারমিশনের নেতৃত্বদানকারী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কিলার সুমন ব্যাপারীকেও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আউয়াল। উদ্দেশ্য ছিল- নিজের সকল অপকর্মের সাক্ষী সুমনের মুখ চিরতরে বন্ধ করা; আর বেঈমানির শিক্ষা দেওয়া। কারণ, পল্লবীর উত্তর কালশী ও বাউনিয়া মৌজায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সরকারি অধিগ্রহণের জমি জবরদখলের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আবাসন প্রকল্পের পালিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হোতা কিলার সুমন সাবেক এমপি আউয়ালের হয়ে কাজ করলেও গোপনে যোগাযোগ রাখতেন আউয়ালের প্রধান প্রতিপক্ষ স্থানীয় অন্য একটি আবাসন প্রকল্পের মালিকের সঙ্গেও। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আউয়ালের সব গোমর সুমন ফাঁস করে দিতেন ওই মালিকের কাছে। বিষয়টি জেনে সুমনকে মেরে বেঈমানির শিক্ষা দেওয়া ছাড়াও প্রতিপক্ষ ওই আবাসন প্রকল্পের মালিককেও ফাঁসাতে চেয়েছিলেন আউয়াল।
আরও জানা গেছে, সুমনকে মারতে পল্লবীর শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত বাবুর গ্রুপের প্রধান বাবু ও দলটির সদস্য হকি সুমন ছাড়াও আরও এক কিলারকে সুপারিও (টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের টার্গেট ভিকটিমকে হত্যার নির্দেশ) দিয়েছিলেন আউয়াল। এ লক্ষ্যে অগ্রিম বাবদ ৩০ হাজার টাকা লেনদেনও হয় তাদের মধ্যে। কিন্তু সুমনকে কিলিংয়ের এই ছকের বিষয়ে জেনে যায় সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সুমনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক পল্লবী কালাপানির মুসা বাহিনীর প্রধান মুছা। তিনি সুমনের কাছে এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দিলেও বিষয়টি চেপে গিয়ে সতর্কতার সঙ্গে তার অন্যতম পথের কাঁটা সাহিনুদ্দিকে হত্যার বিষয়ে আগের অবস্থানেই থেকে যায় সুমন।
অন্যদিকে, ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান আউয়ালের হ্যাভেলি প্রপার্টিজের আলী নগর প্রকল্প এগিয়ে নিতে অন্যতম বাধা ছিলেন নিহত সাহিনুদ্দিন ও তার ভাই মাইনুদ্দিন। হ্যাভেলি প্রপার্টিজের বিরোধিতা করে দুই ভাই আগে পল্লবীর বুড়িরটেক এলাকার একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মালিক অবঃ মেজর মোস্তফা কামালের পক্ষে কাজ করলেও সম্প্র্রতি হ্যাভেলি প্রপার্টিজের এমডি আউয়ালের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন সাহিনুদ্দিন। আগের সব বিভেদ ভুলে এই যুবক আউয়ালের সঙ্গে জোট বাঁধলেও মন থেকে তাকে মেনে নিতে পারেননি সাবেক এমপি; সব বিষয়েই সন্দেহ করতেন তাকে। প্রতিপক্ষ গ্রুপকে দুর্বল করতে আউয়াল ২০-৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে হলেও সাহিনুদ্দীনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন সুমনের সঙ্গে।
আউয়াল ভেবেছিলেন, পল্লবী থানার অসাধু কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে ম্যানেজ করে আগের অপরাধগুলো যেভাবে তিনি ধামাচাপা দিয়েছিলেন, সাহিনুদ্দিকে মেরে টাকার জোর খাটিয়ে সে যাত্রায়ও উতরে যাবেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ভৈরবের একটি মাজার থেকে ধরা পড়েন তিনি। আউয়াল ও সুমন বর্তমানে পুলিশের রিমান্ডে। সেখানে সাহিনুদ্দিনকে খুনের ব্যাপারে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তারা। তাছাড়া কিলার সুমন ও টিটুর মোবাইল থেকেও খুনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
এ দিকে সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার অন্যতম আসামি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুমন ব্যাপারী আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে সুমনকে গতকাল সোমবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার হোসেন। তার আবেদনে মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারী ১৬৪ ধারায় সুমনের ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ জবানবন্দি রেকর্ড করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বলে প্রসিকিউশন পুলিশের উপ-কমিশনার জাফর হোসেন জানান। এ নিয়ে আলোচিত এ মামলায় মোট ৩ আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন।
গত ১৬ মে বিকালে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৩১ নম্বর সড়কে সাহিনুদ্দিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তার ছেলের সামনে। ওই ঘটনায় তার মা আকলিমা বেগম সাবেক এমপি আউয়াল ও ছাত্রলীগ নেতা সুমনসহ ২০ জনকে আসামি করে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন।
নৃশংস এই হত্যাকা-ের একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে সুমনের সহযোগী মানিক ও মনিরকে সরাসরি হামলায় অংশ নিতে এবং সাহিনুদ্দিনের শরীরের বিভিন্ন অংশে কোপাতে দেখা যায়। ওই দুইজন ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। মামলায় ১ নম্বর আসামি আউয়ালকে গত ২০ মে ভৈরবের একটি মাজার থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। আর ‘হত্যার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানকারী’ সুমনকে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সুমনকে ওইদিন আদালতে হাজির করা হলে মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারী তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। সেই রিমান্ড শেষে আদালতে জবানবন্দি দিলেন সুমন।
হত্যার তদন্তের অংশ হিসেবে গতকাল সোমবার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাহিনুদ্দিনের ৬ বছরের ছেলে মাশরাফি, মামলার বাদী নিহতের মা আকলিমা বেগম ও তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তারকে অফিসে ডেকে নেন মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা। সেখানে ৩ জনের কাছে হত্যাকা-ের আগে-পরে ভিকটিম, অভিযুক্ত ও সন্দেহভাজনদের কার কী ভূমিকা ছিল এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চান। তারা তাদের বক্তব্য পেশ করেছেন।
নিহত সাহিনুদ্দিনের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার আমাদের সময়কে জানান, মামলার তদন্ত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাদের ডিবি অফিসে ডেকেছিলেন কর্র্মকর্তারা। ডিবির গাড়িতেই যান ৩ জন। বাদী ও ভিকটিমের কাছ থেকে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর নেওয়া ছাড়াও এতদিন কেন জমির বিরোধ মেটানো হয়নি তাও জানতে চাওয়া হয়। চোখের সামনে বাবাকে কুপিয়ে খুনের মর্মান্তিক সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাশরাফির কাছে তেমন কিছু জানতে চাওয়া হয়নি। ট্রমা থেকে বের করে আনতে বাবার মৃত্যুর বিষয়ে শিশুটিকে যেন কেউ নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত না করে এ বিষয়ে ভিকটিমের পরিবারের কাছে অনুরোধ রাখেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
মাহমুদা আক্তার আরও জানান, দীর্ঘদিন ধরে হ্যাভেলি কোম্পানির সঙ্গে তাদের বিরোধ চলছে। অসংখ্য মামলা ও একাধিকবার হামলা চালিয়েও সাহিনুদ্দিনকে বাগে আনতে না পেরে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়ায় আউয়াল ও তার লোকজন। তবে হ্যাভেলির সঙ্গে সমঝোতা করলেও জমির দখল না ছাড়ায় আউয়ালের নির্দেশে সুমন তার সহযোগীদের নিয়ে সাহিনুদ্দিনকে খুন করে। মামলা করায় এখন পর্যন্ত কেউ তাদের হুমকি না দিলেও কখন কী হয় এই শঙ্কায় চরম নিরাপত্তাহীনতা ভুগছেন তাদের পুরো পরিবার। স্বামীর হত্যাকারীদের ফাঁসি দাবি করেন মাহমুদা।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পল্লবী অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আহসান খাঁ জানান, ভিকটিমের পরিবারের অভিযোগসহ সম্ভাব্য সব বিষয়কে সামনে রেখে চাঞ্চল্যকর সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। এ হত্যামামলায় এ পর্যন্ত ১০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। হ্যাভেলি প্রপার্টিজের মালিক গ্রেপ্তার এম এ আউয়ালসহ সাতজনকে রিমান্ডে রেখে বর্তমানে ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রিমান্ডে আসামিরা আউয়ালের নির্দেশে সাহিনুদ্দিনকে খুন করার কথা স্বীকার করলেও এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না আউয়াল। যদিও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া তিনজন বর্তমানে কারাগারে আছেন। ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান।